বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ এবং বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ এবং রিজার্ভের অবস্থান এই চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রতিফলিত করছে। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছিল, বৈশ্বিক মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মুদ্রাস্ফীতির মতো বহিরাগত কারণগুলো বর্তমানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বৈদেশিক ঋণের অবস্থা
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান, এবং ২০২৪ সালের জুন মাসের হিসাবে বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৯৬.৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। যদিও এই ঋণ সরকার প্রধানত অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহার করছে, ঋণের সুদের বোঝা বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ঋণের বিশাল অংশ আসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF), বিশ্বব্যাংক, এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) থেকে, যা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে ব্যয়িত হচ্ছে।
তবে, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণকে তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য বলা হয়, কারণ দেশের জিডিপি (GDP) এর তুলনায় ঋণের পরিমাণ এখনও সহনীয় স্তরে রয়েছে। ২০২৪ সালে, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল প্রায় ৩৫%, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম। তবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার মন্থর হলে এই ঋণের বোঝা আরো জটিল হতে পারে(
রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা
- বাংলাদেশের রিজার্ভ সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২৩ সালের শেষে, রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে, যা অতীতের তুলনায় অনেক কম।
- ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের উপরে ছিল।
- রিজার্ভের এই হ্রাসের কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয় কমে যাওয়া।
- বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যশস্য এবং সার আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি, এবং প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) কিছুটা হ্রাস পাওয়ার ফলে রিজার্ভে এই প্রভাব পড়েছে।
- বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে খরচ করেছে, যা রিজার্ভ কমাতে সাহায্য করেছে।
- এতে করে দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপও বাড়ছে
সার্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেমন:
- মুদ্রাস্ফীতি: খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ জনগণের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
- বৈশ্বিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলার ব্যাঘাত মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত করেছে।
- রপ্তানি খাতের চাপ: বাংলাদেশ রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি, যেখানে পোশাক শিল্প সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
- কিন্তু বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ে প্রভাব পড়ছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেতারা ব্যয় সংকোচন করায় বাংলাদেশের পোশাক খাতে অর্ডার কমেছে।
- বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চাপ: রেমিট্যান্স আয় কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় এবং আমদানি ব্যয়ের চাপ বাড়ায়, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
- এতে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক হয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও সমাধান
বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ এবং বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি সংকট থেকে উত্তরণের জন্য স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
- বিনিয়োগ আকর্ষণ: স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ প্রয়োজন।
- প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়ন: উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য শিল্পখাতের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
- রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ: পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতের উন্নয়ন এবং বৈচিত্র্যকরণ দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হলেও বর্তমান বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অর্থনীতিকে পুনরায় স্থিতিশীল করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।